প্রাকৃতিক সম্পদের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ: কেন আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিক থেকে পিছিয়ে আছি এবং উত্তরণের উপায়
বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে যথেষ্ট নয় বলে আমি মনে করি। এ দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের সমারোহ থাকা সত্ত্বেও কেন আমরা এত পিছিয়ে আছি, তা নিয়ে ভাবা জরুরি। যদিও প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, পানি, এবং উর্বর জমির মতো প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, কিন্তু এসব সম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে আমরা আমাদের পূর্ণ সম্ভাবনা অর্জন করতে পারছি না।
কেন আমরা পিছিয়ে আছি?
১. প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার না করা
আমাদের দেশে প্রাকৃতিক সম্পদ থাকলেও তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অব্যবস্থাপনা রয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার কম এবং পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাব আমাদের সম্পদের কার্যকর ব্যবহারে বাধা সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, গ্যাস বা কয়লার মতো গুরুত্বপূর্ণ সম্পদগুলো থেকে আমরা যে সুবিধা পাওয়া উচিত তা পাচ্ছি না।
২. দুর্নীতি এবং দুর্বল প্রশাসনিক ব্যবস্থা:
দেশের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রচলন রয়েছে, যা উন্নয়নের পথে বড় বাধা। দুর্নীতির কারণে সরকারি তহবিলের অপচয় হয়, উন্নয়নমূলক কাজের অগ্রগতি ব্যাহত হয়, এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দেশের প্রতি আস্থা হারায়। দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ এখনও অনেক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মাপকাঠিতে পিছিয়ে রয়েছে।
৩. অধিক জনসংখ্যার চাপ:
বাংলাদেশের জনসংখ্যা অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ, যা প্রাকৃতিক সম্পদ এবং অবকাঠামোর ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য পর্যাপ্ত শিল্প প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় বেকারত্বের হার বাড়ছে। আমাদের অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে বিশেষ করে শিল্প এবং কৃষিতে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা জরুরি।
৪. শিল্পের বৈচিত্র্যের অভাব:
আমাদের অর্থনীতি প্রধানত পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা, ও শক্তি খাতের মতো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে তেমন বিনিয়োগ বা উন্নয়ন হচ্ছে না। একাধিক খাতে বিনিয়োগ না করলে দেশের অর্থনীতি বৈশ্বিক বাজারের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে।
৫. দুর্বল অবকাঠামো:
বাংলাদেশের অবকাঠামো এখনও খুবই দুর্বল। বিদ্যুৎ সরবরাহের সমস্যা, অপর্যাপ্ত পরিবহন ব্যবস্থা এবং উন্নত প্রযুক্তির অভাব দেশের শিল্প ও বাণিজ্য কার্যক্রমকে ধীর করে দেয়। এটি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আগ্রহও কমিয়ে দেয়।
ধনী দেশ হিসেবে উত্তরণের পথ
বাংলাদেশকে উন্নত এবং ধনী দেশে পরিণত করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন:
১. প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি
দেশে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার জন্য বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা প্রয়োজন। যেমন- তথ্য প্রযুক্তি, ই-কমার্স, এবং স্বাস্থ্যসেবার মতো খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যাতে বৈচিত্র্যময় অর্থনীতি গড়ে ওঠে।
২. দক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা এবং প্রশিক্ষণ
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে দক্ষ জনশক্তি গঠনের জন্য পুনর্গঠন করা জরুরি। বিশেষ করে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিতের (STEM) ক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষার মান বাড়ানো প্রয়োজন। এর পাশাপাশি, কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বাড়ালে দক্ষ কর্মী গঠিত হবে, যা শিল্প ও প্রযুক্তিখাতে নতুন উদ্ভাবন আনতে সাহায্য করবে।
৩. দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা
উন্নয়নের পথে দুর্নীতিকে একটি বড় বাধা হিসেবে ধরা হয়। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ এবং সুশাসনের প্রতিষ্ঠা করা একান্ত প্রয়োজন। সরকারের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি হবে।
৪. কৃষি এবং শিল্প খাতে উন্নয়ন:
কৃষি খাতে আরও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণ প্রয়োজন, যাতে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো যায় এবং রপ্তানি বাড়াতে সক্ষম হয়। পাশাপাশি পোশাক শিল্পের বাইরেও নতুন শিল্প খাত তৈরি করতে হবে, যা শ্রমশক্তির দক্ষতা বাড়াবে এবং দেশের আয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।
৫. আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং সম্পর্ক উন্নয়ন:
বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক হতে বাংলাদেশকে তার বাণিজ্য নীতি ও চুক্তি আরও জোরদার করতে হবে। বাংলাদেশকে তার ভৌগোলিক সুবিধা কাজে লাগিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত করা যেতে পারে।
উপসংহার:
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও বিশাল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন সম্ভব, তবে তা অর্জনের জন্য সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকরী বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। দুর্নীতি দমন, প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার, দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা এবং অবকাঠামোর উন্নয়ন—এই সবকিছুই দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির মূল চাবিকাঠি। যদি সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায় এবং শিল্প খাতে বৈচিত্র্য আনা যায়, তাহলে বাংলাদেশ তার উন্নয়নশীল অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে একটি ধনী ও স্বনির্ভর দেশে পরিণত হতে পারে।
Comments
Post a Comment